মহান আল্লাহ মানব জাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালনার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুলকে দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন। তাদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুলকে পাঠিয়েছেন সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত হিসেবে। তাই তাঁকে বলা হয় ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’। অর্থাৎ সকল জগতের জন্য রহমত। এই উপাধি কেবল তাঁর অনন্য গুণাবলির স্বীকৃতি নয়, বরং মানবতার জন্য তাঁর অসামান্য অবদানের একটি সর্বজনীন স্বীকৃতি।
‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ আরবি শব্দ। রাহমা মানে দয়া বা করুণা, আর আলামিন মানে সকল সৃষ্টি বা জগৎ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ বলেন, ‘অতএব হে নবী, আমি আপনাকে বিশ্বজাহানের জন্য করুণার নিদর্শন রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে পাঠিয়েছি’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, তিনি সমস্ত সৃষ্টিজগতের জন্য আল্লাহর রহমতের প্রতীক।
রাসুলুল্লাহর (সা.) জীবন ছিল দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, ক্ষমাশীলতা ও ন্যায়পরায়ণতার অনন্য দৃষ্টান্ত। তায়েফে যখন আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দিতে যান, তখন সেখানকার লোকেরা তাঁকে পাথরে রক্তাক্ত করে। তখন মহান আল্লাহ তাঁর পক্ষে ফেরেশতা পাঠিয়ে তায়েফ ধ্বংসের প্রস্তাব দিলে নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি চাই না তাদের ওপর আজাব আসুক। বরং তারা যেন ভবিষ্যতে আল্লাহর ওপর ইমান আনে।’
সহিহ মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমি জগতসমূহের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছি, শাস্তিদানকারী হিসেবে নয়।’
অপর এক হাদিসে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না; সুসংবাদ দাও, বিমুখ করো না (বুখারি ও মুসলিম)।’ পশুপাখির প্রতিও নবীজির (সা.) মমতার বহিঃপ্রকাশ ছিল তাঁর কর্মে। তিনি বিড়াল পুষতেন ও প্রাণিকুলের প্রতি অসীম ভালোবাসা দেখিয়েছেন।
মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘হে লোক সকল! কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর অনারবের, এমনিভাবে সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ হজরত আদম (আ.)-এর সন্তান। হজরত আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট। তোমরা অধীনস্তদের প্রতি খেয়াল রাখবে। তোমরা যা খাবে, তাদের তা খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে তাদের তা পরাবে। সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করিও না। কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে।’…(তিরমিজি)
হজরত আলী (রা.) হজরত রাসুলুল্লাহর (সা.) আচরণ সম্পর্কে হজরত হুসাইনের (রা.) এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল ও বিনম্র স্বভাবের অধিকারী। তিনি রূঢ়ভাষী ও কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন না। তিনি উচ্চ স্বরে কথা বলতেন না, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতেন না, অপরের দোষ খুঁজে বেড়াতেন না। তিনি কৃপণ ছিলেন না। তিনি অপছন্দনীয় কথা থেকে বিরত থাকতেন। তিনি কাউকে নিরাশ করতেন না, আবার মিথ্যা প্রতিশ্রুতিও দিতেন না।
অর্থহীন বিতর্কে লিপ্ত হওয়া, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা এবং অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রসঙ্গের পেছনে লাগা– এই তিনটি বিষয় থেকে তিনি দূরে থাকতেন। অন্যের বেলায়ও তিনটি বিষয় থেকে বিরত থাকতেন– কাউকে মন্দ বলা, কারও দোষ-ত্রুটি তালাশ এবং কারও গোপন অন্বেষণের জন্য আড়ি পাতা।’ (তিরমিজি)
ইসলামের পূর্ণতা আনতে নবীজির (সা.) জীবনে আত্মত্যাগ ও বিসর্জনের বিশদ অধ্যায় রচিত হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও অন্যান্য মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না।’ (সহিহ্ বুখারি)
মহানবী (সা.) ছিলেন মানব জাতি, জিন জাতি ও সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিকেই রাহমাতুল্লিল আলামিন হওয়ার নিদর্শন পাওয়া যায়। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ সমগ্র মানব জাতির জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়।