মিলেমিশে করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ – কথাটি যেনো মিলে যায় সিলেটের পাথর লুটের ঘটনায়। সিলেটের রাজনীতির ‘সৌন্দর্য’ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সৌহার্দ্য। চোরাচালান, বালু-পাথর লুটসহ নানা অপকর্মেও তাঁদের ‘মিলমিশের’ বিষয়টিও বেশ আলোচিত-সমালোচিত। বিখ্যাত পর্যটন স্পট সাদাপাথরের পাথর লুটের পর বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সিলেটের পাথর লুটের পেছনে রয়েছে ২০ জনের একটি সিন্ডিকেট। এ লুটপাট হয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর সম্মিলিত অংশগ্রহণে।
৫ আগস্টের পর এর অন্যতম হোতা- উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বাবুল আহমদ বাবুল, ইসলমাপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সেবুল আহমদ, ৯নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ইসমাঈল মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক হুঁশিয়ার আলী, ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ফয়জুর রহমান, জালিয়ারপাড় গ্রামের আব্দুর রসিদ, মাজারের সাবেক খাদেমের ছেলে মনির হোসেন, জামায়াত কর্মী ইয়াকুব আলী।
যুবদলের বাবুল একসময় চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। তারপর থেকেই এলাকায় পরিচিত বাবুল চেয়ারম্যান নামে। শাহ আরেফিন টিলা থেকে পাথর লুটের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
পাথর তুলে নয়, তা পরিবহন করে ক্রাশার মিলে পৌঁছে দেন ইউনিয়ন জামায়াতের কর্মী ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, গাড়ি থেকে পাথর কিনে মিলে বিক্রি করেন তিনি। এতে ঘনফুটপ্রতি এক দুই টাকা লাভ হয় বলে জানান তিনি।
তবে আওয়ামী লীগের যারা পাথর লুটের সাথে জড়িত ছিল তারা এখন পলাতক। ক্ষমতায় থাকতে টিলা থেকে পাথর তোলায় তারাই ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে।
এই লুটপাট প্রশাসন কী ঠেকাবে? পুলিশের বিরুদ্ধেই পাথরবাহী ট্রাক আর ট্রাক্টরগুলো থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো সাদাপাথর এলাকা থেকে দেড় কোটি ঘনফুট পাথর কারা লুট করেছে? যারা করেছে, তারা নদীপারের জায়গা দখল করে ভাড়া দিতো লুটের পাথর স্তূপ করে রাখার জন্য।
ধলাই নদীর পূর্বে একশর বেশি আর পশ্চিমে দেড় শতাধিক ‘পাথর রাখার জায়গা। এগুলোর ভাড়া দিনে ২ হাজার টাকা। তিনজন শ্রমিককে দেয়া হতো একটি নৌকা। লুটের পর বিক্রি শেষে নৌকার মালিক এক ভাগ, বাকি ৩ ভাগ ওই ৩ শ্রমিকের। যারা জমি ভাড়া নেন, তারা শ্রমিকদের কাছ থেকে পাথরগুলো কিনতেন চার ভাগের এক ভাগ দামে। এক নৌকা পাথরের দাম ৮ হাজার। সেই পাথর তারা শ্রমিকদের কাছ থেকে কেনেন মাত্র ২ হাজারে! বাকী ৬ হাজার নদীতেই লাভ যাদের, তারাই দৈনিক তুলে নিয়েছেন সোয়া কোটি টাকা করে?
৫ আগস্টের পর উপজেলা বিএনপির পদ স্থগিত করা সভাপতি সাহাব উদ্দিন ছিলেন লাভের ক্ষেত্রে শীর্ষে। তারপরই যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ দুদু। এছাড়া পূর্ব পারের নেতৃত্ব জেলা যুবদলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক বাহার আহমেদ রুহেল, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, সদস্য গিয়াস মিয়া।
পাথর লুটের ঘটনা সামনে আসায় বিএনপি থেকে পদ হারান সাহাব উদ্দিন। বাড়িতে পাওয়া যায়নি তাকে। বাইরে পাথরের স্তুপ আর পাথর উত্তোলনের মেশিন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, কিছু জমি তার দখলে ছিল সত্যি; কিন্তু পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। উল্টো লুট ঠেকাতে আন্দোলনও করেছি।
লুটপাটে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা কালাইরাগের দুলাল মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আমিনুল ইসলাম ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শাহাবুদ্দিন। তারা এখন পলাতক।
পাথর লুটপাটের ঘটনায় সামনে আসে আরও ৫১ জনের নাম। যারা সবাই পাথর উত্তোলনের এ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পূর্ব পারের জমির দখলদার ও পাথর ব্যবসায়ী তারা। তালিকায় আছেন- জেলা যুবদল সদস্য মোস্তাকিম আহমেদ ফরহাদ, পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আলিমুদ্দিন, উপজেলা বিএনপির সদস্য হাজী কামাল, যুবদল কর্মী আজিজুল মাহমুদ, সাবাহ উদ্দিনের ছেলে এজাজ মাহমুদ, ফুপাতো ভাই শৈবাল শাহরিয়ার সাজন, ভাতিজির জামাই সালাউদ্দিন, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, তার ছেলে রিয়াজ উদ্দিন, জৈন উদ্দিন, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন দুদুর ভাই বোরহান, উপজেলা যুবদলের সদস্য মানিক মিয়া, আরমান আহমদ, যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম, জাকির, ভোলাগঞ্জ গ্রামের মোজাফর, নুর উদ্দিন, মইন উদ্দিন, সালাউদ্দিন, রাজু মিয়া, রাজু মিয়া, রনি, কালা মিয়া, রোকন মিয়া, লাল মিয়া, আজিজুল, আহাদ মিয়া, বেরাই, দুলাল, তেরা মিয়া, রনি, পাড়ুয়া নোয়াগাঁও গ্রামের সাইফুল, শফিকুল, বাঘারপার গ্রামের আব্দুল মতিন, দক্ষিণ ঢালারপার গ্রামের আব্দুস সালাম, সিদ্দিক মিয়া, মধ্য রাজনগর গ্রামের লায়েক মিয়া, নয়াগাংগেরপার রাজু, আখলু, ইমরান, তৈমুরনগর গ্রামের রাজ্জাক, জব্বার, আহাদ, লায়েক, ঘোড়ামারা এলাকার আশিক। এছাড়া ছাত্রদল নেতা হাফিজুর রহমান হাবিব, মোফাজ্জল হোসেন রোমান, জুবায়ের, হারুনুর রশিদ, আমিন রহিম।
আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে হুমায়ুন আহমেদ হুমন আর সাব্বিরের নামও। ভোলাগঞ্জের খেলার মাঠে পাওয়া গেলো হুমনকে। তার দাবি, বৈধভাবে পাথর উত্তোলনের আন্দোলন করছেন তিনি।
পুরো এলাকার জীবিকাই লুটের পাথর কেন্দ্রীক। সাদাপাথর, জাফলং, আরেফিন টিলা আর রাংপানি থেকে ১ বছরে লুট হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ঘনফুট পাথর। উদ্ধার করা গেছে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ লাখ ঘনফুট। যেগুলো বিক্রি হয়ে গেছে, আর পাওয়া যাবে না সেসব। আর যেগুলো চূর্ণ করা হয়ে গেছে সেসব আর উদ্ধার করে কোনও লাভ নেই।