নির্বাচন যদি বৈধ না হয়, তাহলে তা আয়োজনের কোনো অর্থ নেই বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার (১৩ আগস্ট) সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা জানান।
সিএনএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করছে। এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির প্রথম নির্বাচন, যার এক বছরেরও বেশি সময় আগে সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি এই সংস্কার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তিনি সিএনএকে বলেন, ‘নির্বাচন বৈধ না হলে তা আয়োজনের কোনো অর্থ নেই। আমার কাজ হলো গ্রহণযোগ্য, পরিচ্ছন্ন এবং উপভোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। আমরা আমাদের নির্ধারিত লক্ষ্যগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।
অনেক কিছু সংস্কার করতে হয়েছে, কারণ আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল জালিয়াতি, অপব্যবহার এবং দুর্নীতিতে ভরা।’
মারণাত্মক বিক্ষোভ
গত জুলাইয়ে দীর্ঘদিনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে ছাত্রনেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ নিরাপত্তা বাহিনী ও তার আওয়ামী লীগ দলের সমর্থকদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়।
এই বিদ্রোহ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়, যা ছিল কর্তৃত্ববাদ, ব্যাপক দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভিন্নমত দমনের অভিযোগে কলঙ্কিত।
আগস্টে হাসিনা প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যান এবং অনুপস্থিতিতেই তার বিচার চলছে।
অভিযোগ রয়েছে যে তিনি এমন এক দমন অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেখানে ১,০০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। এরপর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ বাংলাদেশ তাকে ফেরত চেয়েছে। ভারত প্রত্যর্পণ অনুরোধে কোনো সাড়া দেয়নি।
ঢাকা নয়াদিল্লিকে আহ্বান জানিয়েছে হাসিনাকে মিথ্যা ও মনগড়া বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখতে, কারণ তিনি অনলাইনে সমর্থকদের অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিরোধে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।
ড. ইউনূস সিএনএকে বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যাখ্যা করেছেন যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা হাসিনাকে ভারত থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছি।’ আমরা বলেছি, ‘আপনারা তাকে রাখুন, আমাদের বিচার চলবে। তবে এর মধ্যে তাকে বাংলাদেশ অস্থিতিশীল করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। তার এখনো অনেক অনুসারী আছে, যারা আগের মতোই দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে
কূটনৈতিক পরিবর্তন
হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। কিন্তু নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ঢাকা তার আঞ্চলিক জোটগুলো পুনর্গঠন করছে এবং ভারতের ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে।
মার্চে ড. ইউনূস চীনে ঐতিহাসিক সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রবেশদ্বার হিসেবে তুলে ধরেন।
তিনি সরকারের এই পদক্ষেপের সাফাই দিয়ে বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিকভাবে পরিচালিত এবং যে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহী, বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে, ভারতের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক চাই। এটি বিনিয়োগের সুযোগের বিষয়, চীনের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা নয়। একই সুযোগ ভারত বা অন্য কেউও নিতে পারে। এটা শুধু ব্যবসায় ন্যায্য প্রতিযোগিতা।’
রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো
নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. ইউনূস, যিনি বিপ্লবের পর এই ভূমিকায় আসেন, জানিয়েছেন যে তিনি প্রথমে কার্যত সরকারপ্রধান হওয়ার দায়িত্ব নিতে চাননি।
তিনি বলেন, ‘(ছাত্রনেতারা) আমাকে অনুরোধ করেছিল যে এত রক্ত ঝরেছে… সেটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল… তারা এত ত্যাগ করেছে, আমাকেও কিছু করতে হবে। তাই আমি দায়িত্ব নিয়েছি।’
৮৫ বছর বয়সী এই নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচনের পর তিনি সরকারে থাকার পরিকল্পনা করছেন না। রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের মধ্যে ড. ইউনূস আশা প্রকাশ করেছেন যে তার নেতৃত্ব একটি স্থায়ী উত্তরাধিকার রেখে যাবে।
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করব, এখন থেকে বাংলাদেশ সঠিক পথে চলবে, আর বিপথগামী হবে না। আমাদের ভোটাররা গত ১৫ বছরে ভোট দিতে পারেনি। তরুণরা তাদের ভোট ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যালট বাক্সে ঢালবে। আমি চাই একটি ভালো সরকার আসুক, যা গণতান্ত্রিক নীতিমালা মেনে চলবে।’
কুয়ালালামপুরে তিন দিনের সরকারি সফরের সময় ড. ইউনূস সিএনএকে এসব কথা বলেন। যেখানে তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সফরে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, শিক্ষা এবং এলএনজি, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো সরবরাহে সহযোগিতাসহ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে।