শেখ হাসিনার সরকারের পতনের এক বছর পার হতে না হতেই যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী সাবেক ক্ষমতাসীনদের বিলাসবহুল সম্পত্তি কেনাবেচা, স্থানান্তর ও পুনঃঋণায়নের তথ্য উঠে এসেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এবং আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’র যৌথ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য। (খবর দ্য গার্ডিয়ান)
গত মে মাসে যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ দমন সংস্থা (এনসিএ) হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার মালিকানাধীন প্রায় ১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকার অ্যাপার্টমেন্ট জব্দ করে। এরপর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে থাকা প্রায় ২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকার ৩০০-এর বেশি সম্পত্তি জব্দ হয়।
তদন্তে দেখা গেছে, গত এক বছরে যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ২০টি সম্পত্তি লেনদেনের আবেদন জমা পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহানের নামে নাইটসব্রিজের চারতলা বাড়ি-প্রথমে হস্তান্তর, পরে বিক্রি এক অজ্ঞাত হিসাবরক্ষকের মালিকানাধীন কোম্পানির কাছে (৭.৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড)। তার ভাই শাফিয়াত সোবহানের নামে সারে’র ভার্জিনিয়া ওয়াটারে ৮ মিলিয়ন পাউন্ডের ম্যানসন লেনদেনের প্রমাণ। সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান গত জুলাইয়ে রিজেন্টস পার্কের ১০ মিলিয়ন পাউন্ডের টাউনহাউস বিক্রি করেন, সঙ্গে আরও তিনটি ‘রিফাইন্যান্স’ আবেদন।
সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান ও ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের মালিকানাধীন গ্রোসভেনর স্কয়ারের ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডের অ্যাপার্টমেন্ট এনসিএ ফ্রিজ করেছে।
তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হচ্ছে। আমরা যেকোনো তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করব।’
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যতক্ষণ না তদন্ত শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ যেন এসব সম্পদ বিক্রি, স্থানান্তর বা বন্ধক না রাখা হয়।
গভর্নর মনসুর বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত অনেকে এরই মধ্যে সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। তাই আরও জোরালোভাবে সম্পদ ফ্রিজ করা জরুরি।’
দুর্নীতিবিষয়ক অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের প্রধান জো পাওয়েল বলেন, ‘ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যদি সম্পদ জব্দ না করা হয়, তবে সেগুলো দ্রুত গায়েব হয়ে যায়। লন্ডন যেন দুর্নীতির স্বর্গ না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
তদন্তে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এসব সম্পদ লেনদেনে যুক্তরাজ্যের আইনজীবী ও পরামর্শদাতারা কী যথাযথ যাচাই-বাছাই করেছেন? তাদের ভূমিকা ও সতর্কতা নিয়ে উঠছে নানা সন্দেহ।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই ব্রিটেনে সম্পদ হস্তান্তরের প্রবণতা বাড়তে থাকে। লন্ডনের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানে জমা পড়া নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি দ্রুত সম্পত্তি বিক্রি কিংবা রিফাইন্যান্সের চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে এবং গার্ডিয়ান-ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এখন আরও তৎপর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তদন্ত শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের দায়বদ্ধতা ও অবস্থান নির্ধারণেও একটি পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে।