‘চব্বিশে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো দেখেই মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, আজকের সমন্বয়কদের ডাকে নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী হানিয়াম মারিয়া।
তিনি বলছেন, সাধারণ মানুষ এত রাজনীতির প্যাঁচ বোঝে না। নিজেদের সন্তানকে নিজের দেশের রাস্তায় মরতে দেখতে পারবে না। সেই সময়ে মানুষ দল দেখে সিদ্ধান্ত নেয় না। অনেকেরই কিন্তু কোটার দরকার ছিলো না। তারপরও রাস্তায় নেমেছে। গতকাল রবিবার (৩ আগস্ট) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজ অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এ মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক কাজী হানিয়াম মারিয়ার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি ডিআরবির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
আজকে (রবিবার) ডিন অফিসে জুলাই স্মৃতিচারণে অনুষ্ঠানে দুজন স্টুডেন্টের কথা শুনলাম। দুজনই স্মৃতি বিজরিত হয়ে ভেজা চোখে কান্নাজড়িত কন্ঠে কথা বলেছে এবং সেই আবেগ সবাইকে স্পর্শ করেছে। এর মাঝে গণিত বিভাগের দেলোয়ারের (নাম ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী) কথা এবং কান্না মনে আবার দাগ কাটলো। বক্তব্যের শেষের দিকে সে বললো, যে নাহিদ, হাসনাত এবং ওর ডাকে আন্দোলনে এসে অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। এটা ভাবতেই তার অপরাধবোধ হয়। একটা ছোট্ট মানুষ কতটুকু কষ্ট বুকে নিয়ে চলছে! আর কিছু মানুষ ওদের ত্যাগ নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে। সত্যি বলতে, আমি এই প্রথম এই দুজনকে দেখলাম। এর আগে কাছ থেকে নিজের ডিপার্টমেন্ট এবং হলের ছাত্রীদের দেখেছি।
যতটুকু সম্ভব সেসময় এবং পরবর্তীতে শুধু তাদের খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু এদের বাইরে গত জুলাইয়ে এমন বহু নাম না জানা আন্দোলনকারী আছে যাদের আমরা চিনি না। যারা হারিয়ে গেছে তাদের নামও নথিভুক্ত হয়নি। এদের কাছে জুলাই অন্যরকম। যারা হারিয়ে গেছে তাদের আপনজনদের কাছে জুলাই আজীবন বিভীষিকাময় হয়ে থাকবে। আজকের অনুষ্ঠানে এই দুজন (এরমাঝে মেয়েটির পায়ে গুলি লেগেছিলো) নিজেদের জন্য কিছু চায়নি, শুধু বিচার চেয়েছে। ক্যাম্পাস থেকে লেজুরবৃত্তিক (!) ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে চেয়েছে। শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে বললে আরো খুশি হতাম।
গতবছর এই শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালানো দেখেই মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। আজকের সমন্বয়কদের ডাকে নয়। সাধারণ মানুষ এত রাজনীতির প্যাঁচ বোঝে না। নিজেদের সন্তানকে নিজের দেশের রাস্তায় মরতে দেখতে পারবে না। সেই সময়ে মানুষ দল দেখে সিদ্ধান্ত নেয় না। অনেকেরই কিন্তু কোটার দরকার ছিলো না। তারপরও রাস্তায় নেমেছে। ৫ই অগাস্টের পর আজকের দুজন শিক্ষার্থীর মত বেশিরভাগই ঘরে ফিরে গেছে। এরা কোন বিশেষ কিছু পাবার আশায় আন্দোলনে আসে নি। জুলাই ওদের কাছ থেকে বন্ধু/আপনজন কেড়ে নিয়েছে। সারাজীবন জুলাই এদের কাছে বিশেষ স্হান নিয়ে থাকবে। জুলাই ওদের কাছে ট্রমার পাশাপাশি গর্বেরও।
পাঁচই অগাস্টের পর জুলাই বেঁচার কাতারে এদের পাবেন না। জুলাইয়ের স্টেক নিয়ে কামড়াকামড়িতেও এদের দেখবেন না। এরা সবাই আন্ডার রেটেড। যেখানে শিক্ষকরা পর্যন্ত জুলাইয়ে ১/২ দিন মিছিলে গিয়ে সেই ছবি দেখিয়ে কত কিছুই না বাগিয়ে নিয়েছেন, সেখানে এরা অপরাধবোধে ভুগছে যে তার ডাকে আন্দোলনে এসে বন্ধু হারিয়ে গেছে। এই আন্ডাররেটেড ছেলেমেয়েদের জন্যই আমাদের দেশটা এখনো টিকে আছে। বাকী ওভাররেটেড সমন্বয়ক এবং উপদেষ্টাদের কার্যকলাপে জুলাই বিতর্কিত হচ্ছে।
গত একবছরে দেশে আশানুরূপ কোন পরিবর্তন হয়নি। রাতারাতি পরিবর্তনের আশা করাও বোকামি। কিন্তু একবছরে যখন শতকোটি টাকার দুর্নীতি, মব, সেই পুরনো রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা, সমাবেশ থেকে নারী বিদ্বেষী বক্তব্য, শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য, আইন না মানার প্রবণতা জুলাইকে বিতর্কিত করে। এই শিক্ষার্থীদের ত্যাগ, এত প্রাণের বিনিময় যেন গুটিকয়েক লোকের স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম হয়ে গেছে।
প্রিয় দেলোয়ার, ফারিয়া, নাম না জানা অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং আমার শিক্ষার্থীরা, তোমাদের জন্য আমার মত সাধারণ শিক্ষকের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা রইলো। তোমাদের ত্যাগ যেন বৃথা না যায়। তোমাদের আগামী দিনগুলো সুন্দর হোক।