রংপুর সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র (বালিকা) থেকে চার কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। পুলিশ দু’জনকে উদ্ধার করলেও এখনও খোঁজ মেলেনি দু’জনের। উদ্ধার হওয়া কিশোরীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে শিশু-কিশোরীদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। জীবন বাঁচাতে তারা পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।
এদিকে নিরাপদ আশ্রয় প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের এমন কর্মকাণ্ডে সচেতন মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
জানা যায়, রংপুর নগরীর দেওডোবা ডাংগীরপাড় এলাকায় একশ’ শয্যা বিশিষ্ট সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে বর্তমানে প্রায় ৬৮ জন নিবাসী রয়েছে। এখানে হারিয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী, এতিম ও মামলা সংক্রান্ত কারণে আদালত থেকে পাঠানো শিশু-কিশোরীরা থাকেন। গত ১২ জুন রাতে এই কেন্দ্র থেকে নিতু, স্মৃতি, কৃতি ও আশা নামের চার কিশোরী নিখোঁজ হন। সমাজসেবা কার্যালয়ের এ নিয়ে তেমন উদ্যোগ না থাকলেও পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ দু’দিন পর রোববার স্মৃতি ও কৃতিকে উদ্ধার করে।
ওই দিন পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে পুনরায় সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠায়। কিন্তু আদালতের বারান্দায় থাকা স্মৃতির মা নগরীর রবার্টসনগঞ্জের বাসিন্দা মুক্তি বেগম মেয়েকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠাতে পুলিশের কাছে আপত্তি জানান। কারণ ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে মেয়ের উপর নির্যাতন ও তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত তিনি। তার মেয়েকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে নয়, থানার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখতে পুলিশের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু আদালতের আদেশ ছাড়া এটি সম্ভব নয় বলে পুলিশ জানায়।
মুক্তি বেগম অভিযোগ করেন, পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিবাসীদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, রাতের বেলায় পুরুষ মানুষের আসা-যাওয়াসহ নানা অনিয়ম চলে। এছাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে স্মৃতি নিখোঁজ হলে মুক্তি বেগম থানায় জিডি করতে চাইলে ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে তা করতে দেয়নি সমাজসেবা কর্মকর্তারা। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত সমাজসেবা কর্মকর্তারা থানায় জিডি করেন।
পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়া স্মৃতি (১৭) বলেন, এখানকার নিবাসীদের নানা ধরনের শারীরিক-মানসিক ও যৌন নির্যাতন করা হয়। প্রতি রোববার একজন পুরুষ মানুষ পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে নিবাসী মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত দেয়। এরই প্রেক্ষিতে এক মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। এরপর ওই মেয়েটির ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং তাকে এখন আর কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে না। প্রায় সময় মেয়েদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে স্মৃতি বলেন, আমি এর প্রতিবাদ জানালে আমাকে গালি-গালাজ করা হয়।
আদালত আমার মঙ্গলের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখেছিল। কিন্তু সেখানকার অবস্থা দেখে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিলাম। কেন্দ্রের আশা ও মীম নামের দুই কিশোরীও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অনেক মেয়েই নির্যাতনের শিকার হয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকতে চায় না, প্রায় সময় কান্নাকাটি করে। প্রতিবাদী স্মৃতির সাথে আলাপকালে পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বরত এক নারী মিডিয়া থেকে আড়াল করতে উদ্ধার হওয়া অপর মেয়ে কৃতিকে টেনে নিয়ে দ্রুত আদালতপাড়া ত্যাগ করার চেষ্টা করেন। এসময় গণমাধ্যমকর্মীরা কিশোরীকে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে দায়িত্বরত ওই নারী এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান।
তাৎক্ষণিক বক্তব্য নিতে চাইলে নিবাসী কৃতি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নির্যাতনের ভয়ে মুখ খোলেননি।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের গেট বাইরে থেকে বন্ধ। পরিদর্শনের জন্য গণমাধ্যমকর্মীর পরিচয় দিলেও কেন্দ্রটির গেট খুলতে অহেতুক বিলম্ব করে দায়িত্বপ্রাপ্তরা। পরবর্তীতে গেট খুলে গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের সঙ্গে কথা বলেন। কেন্দ্রের নিচতলায় নিবাসীদের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে এক নিবাসী জানান, গত ১২ জুন চার কিশোরী এই কেন্দ্র থেকে পালিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে গণমাধ্যমকর্মীদের জেরার মুখে চার কিশোরী পালিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। মেয়েরা নিজ ইচ্ছায় পালিয়ে গেছে। পালানোর সময় আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত রুমা বেগমের কাছে চাবি ছিল। সেই কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এই ঘটনায় রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মনিমুন আক্তারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মানবাধিকার ও পরিবেশ সংগঠনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এ এ এম মুনীর চৌধুরী বলেন, ‘যে শিশু-কিশোরীদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া ও দেখভালের জন্য রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়েছে; তাদের মধ্যে কেউ যদি হারিয়ে যায়, নিরুদ্দেশ হয়, নির্যাতনের শিকারের অভিযোগ করে তাহলে তা উদ্বেগের বিষয়। যার ওপর দায়িত্ব রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্তসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিবাসীদের রক্ষা করতে সমাজসেবা অধিদফতর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’