রংপুর নগরের ধাপ এলাকা। স্থানীয় আটতলা মসজিদসংলগ্ন ‘রংপুর গ্রুপিং সেন্টার’র সামনে মাঝবয়সী এক ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। পরনে লুঙ্গি আর হাফহাতা শার্ট। পায়ে জুতা নেই। উষ্কখুষ্ক চেহারা। হাঁটাচলাও রহস্যজনক। কথা হয় তার সঙ্গে। নাম জানালেন নিলু (ছদ্মনাম)। রক্ত বিক্রি করতে এসেছেন! ১৩ দিন আগেও এই প্রতিষ্ঠানে তিনি এক ব্যাগ (৪৫০ এমএল) রক্ত বিক্রি করেছিলেন।
বিনিময়ে পেয়েছিলেন ৩০০ টাকা। কেন রক্ত বিক্রি করবেন- এমন প্রশ্নে তার সাবলীল উত্তর, ‘এই টাকা দিয়ে মাদক কিনে সেবন করব। শুধু আমি না, আমার মতো আরও অনেকে এভাবে রক্ত বিক্রির টাকায় মাদক সেবন করেন।’
রংপুর গ্রুপিং সেন্টার’ একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়। নগরীর ধাপ এলাকায় এমন আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে মাদকসেবীরা রক্ত বিক্রি করেন। তাদের রক্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পরীক্ষা করা হয় না। এসব রক্ত আবার বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রতিব্যাগ ১ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। কোনো প্রতিষ্ঠানেরই ব্লাডব্যাংকের লাইসেন্স নেই। নামকাওয়াস্তে দু-একটি ফ্রিজ, সাদা অ্যাপ্রোন আর কিছু ছাপা ফরমই এসব প্রতিষ্ঠানের একমাত্র সম্বল। অথচ তারা বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক/হাসপাতালে দিনের পর দিন রক্ত সরবরাহ করে আসছে। এসব রক্ত সঠিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না হওয়ায় রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অথচ এত ঝুঁকি সত্ত্বেও রংপুরের ‘চিকিৎসানগরী’ হিসেবে পরিচিত ধাপ এলাকায় এমন একাধিক প্রতিষ্ঠান নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর থেকে নগরের ধাপ এলাকায় এসেছেন আকিবুল ইসলাম। তার এক রোগীকে সমতা ক্লিনিক নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার এক ওয়ার্ডবয়কে সঙ্গে দিয়ে তাকে রংপুর গ্রুপিং সেন্টারে পাঠিয়েছেন। সেখান থেকে এক হাজার টাকা দিয়ে তিনি একব্যাগ রক্ত কেনেন। কোনো পরীক্ষা করা হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে আকিবুল বলেন, ‘আমি লেখাপড়া জানি না। তাই তেমন কিছু বুঝিও না। ক্লিনিকের ম্যানেজার রক্ত নেওয়ার জন্য সঙ্গে লোক পাঠিয়েছেন। পরীক্ষা করিয়েছেন কি না তা আমি জানি না।’
এ বিষয়ে কথা হয় সমতা ক্লিনিকের ম্যানেজার মো. রিঙ্কুর সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, ‘আমরা মাদকসেবীদের রক্ত কিনি না। বিভিন্ন ক্লিনিকে অতিরিক্ত রক্ত থাকে। সেগুলো কিনে আনি। সবচেয়ে বেশি আনি ডক্টরস ক্লিনিক থেকে।’
নগরের যত অবৈধ ব্লাডব্যাংক
ধাপ কাকলী লেন রোডের মোজাহিদ গ্রুপিং সেন্টার (পরিচালনা করেন মেহেদী), রংপুর গ্রুপিং সেন্টার (রিঙ্কু), আরকে রোডের হাবিব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাশে ফার্স্ট লাইফ এইড গ্রুপিং সেন্টার, পর্ব গ্রুপিং সেন্টার (প্রদীপ রায়), আপডেটের গলিতে সেতু গ্রুপিং সেন্টার (শরীফ), ধাপ পুলিশ ফাঁড়ির পেছনে আদর্শ ল্যাবরেটরি (ফরিদ), মেট্রো ডিজিটাল ল্যাবের গলিতে নিউ ঢাকা ট্রান্সফিউশন সেন্টার (নুর ইসলাম), মৌচাক বেকারির পেছনে বন্ধন গ্রুপিং সেন্টার (মিলন), এলএস গ্রুপিং সেন্টার (লিটন), মক্কা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভেতরেই শহীদ গ্রুপিং সেন্টার (শহিদুল ইসলাম), রিঙ্কু ব্লাড গ্রুপিং সেন্টার, পপি গ্রুপিং সেন্টারসহ একাধিক ব্লাডব্যাংক রয়েছে। সাইনবোর্ড, ব্যানার বা কোনো ধরনের প্রচার ছাড়াই বিভিন্ন অলিগলিতে চলে এসব প্রতিষ্ঠান। হঠাৎ দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
গত ২৫ জুন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত একজনকে ভর্তি করা হয় ধাপ এলাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে। তখন তার দুই ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। নিউ ঢাকা ট্রান্সফিউশন সেন্টার নামে একটি ব্লাডব্যাংক থেকে রক্ত নেওয়া হয়। ওই রোগীর সঙ্গে ছিলেন রংপুর সিসিআই কলেজের শিক্ষার্থী তানভীন আক্তার। পরীক্ষা করে রক্ত নেওয়া হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। আমাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পরও যদি পরীক্ষা না করায়, সেক্ষেত্রে আমাদের কী করার থাকে? তারা পরীক্ষা বাবদ আমাদের থেকে ৫০০ টাকা নিয়েছিল। আমার মনে হয়, পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত।’ জানা গেছে, তিনি যে প্রতিষ্ঠান থেকে রক্ত নিয়েছিলেন সেই ঢাকা ট্রান্সফিশন সেন্টার ও পর্ব ট্রান্সফিশন সেন্টারকে এর আগে একাধিকবার সিলগালা করা হয়েছিল।
সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, ব্লাডব্যাংক-সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য এখন পর্যন্ত তারা জেলায় দুটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে। সেগুলো হলো- কছির উদ্দিন মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আইডিয়াল হেলথ সিটি। নতুন করে লাইসেন্সের আবেদন করেছে ওয়ান প্লাস ব্লাডব্যাংক, প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমোদন পায়নি।
জানা গেছে, বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালের ম্যানেজাররা রোগীর স্বজনদের এসব অবৈধ সেন্টারে পাঠিয়ে কমিশন নিচ্ছেন। কমিশন বাবদ রোগীপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নেওয়া হয়। ক্লিনিকের ওয়ার্ডবয়রাও পাচ্ছেন পকেট খরচ। ‘রোজ’ নামে একটি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় আয়ুব আলী স্বীকার করেছেন, রোগী পাঠিয়ে তারা ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন।
পর্ব গ্রুপিং সেন্টারের পরিচালক প্রদীপ কুমার মিলন বলেন, ‘কমিশন ব্যবসায়ীরা আমাদের নষ্ট করেছেন। কমিশন কম হলে তারা অন্য জায়গায় রোগী পাঠান। তাই রোগী ধরতে গিয়ে অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে হলেও তাদের শরণাপন্ন হতে হয়।’
বিধি অনুযায়ী, ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স, ব্লাড কালেকশন রুম, সার্বক্ষণিক একজন এমবিবিএস চিকিৎসক, একজন টেকনোলজিস্ট, ব্লাডব্যাংক রেফ্রিজারেটর, এইচআইভি, এইচবিভি, এইচসিভি, ভিডিআরএল, ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা, ওয়েট মেশিনসহ ওই কক্ষের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে এসি থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ ধাপ এলাকায় গড়ে ওঠা অনুমোদনহীন কোনো ব্লাডব্যাংকে এসব নিয়মের বালাই নেই।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মুফেক মাহমুদ বলেন, ‘ব্লাডব্যাংকের জন্য নির্দিষ্ট লজিস্টিক, রেজিস্ট্রার, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। এসব না থাকলে তা হবে সম্পূর্ণ প্রতারণা।’
এ বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী উম্মে ফাতেমা বলেন, ‘এটি সিভিল ক্রাইম। স্বাস্থ্য বিভাগের দেখার কথা। এটি এখনো আমাদের অবজারভেশনে আসেনি। এলে আমরা স্বাস্থ্য বিভাগকে জানাব।’
রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. শহীন সুলতানা বলেন, ‘লাইসেন্সবিহীন সেন্টার চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডিসি অফিসের সহায়তায় অভিযান চালানো হবে।’
এ নিয়ে রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল বলেন, ‘খোঁজখবর নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য উপ-পরিচালক ডা. ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে এসব ব্লাডব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’