জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চার তলার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে উদ্বিগ্ন স্বজনদের ভিড়। প্রধান ফটক বন্ধ, শুধু চিকিৎসক, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবকদের আনাগোনা। এই ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছেন মিজানুর রহমান বিপ্লব, যার সপ্তম শ্রেণির ছেলে নাভিদ নাওয়াজ দীপ্ত জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। গত ২১ জুলাই দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় দীপ্ত গুরুতর আহত হয়। তার শরীরের অর্ধেকাংশ পুড়ে গেছে। এখন সে আইসিইউর বেড নং ৩-এ চিকিৎসাধীন।
দীপ্তর বাবা মিজানুর রহমান জানান, দীপ্ত বন্ধুপ্রিয় ও সাহসী। দুর্ঘটনার দিন সে একা বের না হয়ে বন্ধুদের বাঁচাতে গিয়েছিল। এই সাহসের মূল্য তাকে দিতে হয়েছে নিজের শরীরের অর্ধেকাংশ পুড়ে যাওয়ার মাধ্যমে। তবুও আইসিইউতে শুয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, ‘বাবা, আমি বন্ধুদের সাহায্য করেছি, আমি নিশ্চয়ই বেঁচে যাবো। এই কথায় বাবার বুক ভেঙে যায়। এদিকে জ্বর হলেও ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতেন তিনি, কিন্তু আজ তার হাতটাও ধরতে পারছেন না।
পরিবারে স্ত্রী নুরুন নাহার, ছেলে দীপ্ত ও মেয়ে নাইরা আফরিনকে নিয়ে সুখের সংসার ছিলো মিজানুরের। দীপ্ত ও নাইরা প্রতিদিন হাত ধরে স্কুলে যেতো, স্বপ্ন বুনতো। দুর্ঘটনার দিনও তারা একসঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল। নাইরার ক্লাসের ছুটি হয়ে যাওয়ায় সে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল, কিন্তু দীপ্ত ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। মা নুরুন নাহার গেটে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ বিমান বিধ্বস্ত হয় এবং মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বদলে যায়। নুরুন নাহার অজ্ঞান হয়ে পড়েন, এবং নাইরা ফোন করে জানায় ভাইয়া পুড়ে গেছে।
মিজানুর অফিস থেকে ছুটে আসেন, কিন্তু ততক্ষণে দীপ্তকে প্রথমে সিএমএইচে এবং পরে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়। এখন তিনি ও তার স্ত্রী হাসপাতালেই রয়েছেন। দীপ্তর মামা-মামী, বাবার বন্ধু আদনান ও সোহাগসহ আত্মীয়-বন্ধুরা পাশে আছেন। দীপ্তর বাবার স্কুল বন্ধু মেহরিন চৌধুরী, যিনি মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, এই দুর্ঘটনায় নিজের জীবন দিয়ে ২০ জন শিক্ষার্থীকে বাঁচিয়েছেন। তার এই বীরত্বে বন্ধুরা গর্বিত, তবে শোকাহত।
দীপ্ত পাখি ও বেড়াল ভালোবাসে। একবার মায়ের অ্যালার্জির কারণে বেড়াল পোষা ছেড়ে দেয়। পরে পাখি পোষা শুরু করে। মিজানুর রহমান চোখে জল নিয়ে বলেন, একদিন রাগ করে পাখি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলাম। আজ ছেলে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও পাখিদের যত্ন নেওয়ার কথা বলছে। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে।
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসক, যিনি মিজানুরের স্কুলের সিনিয়র জানান, দীপ্ত আমার সন্তানের মতো। এখানে সব শিশুই আমাদের সন্তান। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি। তবে পোড়া রোগীদের অবস্থা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩২ জন নিহত হয়েছেন এবং ৫১ জন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন, যার মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
দীপ্তর বাবা ও স্বজনরা দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন, যেন দীপ্ত সুস্থ হয়ে নাইরার সঙ্গে খেলতে ও পাখিদের সঙ্গে হাসতে পারে। পুরো বাংলাদেশ দীপ্তদের জন্য কাঁদছে ও প্রার্থনা করছে।