সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের পক্ষপাতী নয় বিএনপিসহ ছয়টি দল। বিএনপির প্রস্তাব– বিদ্যমান নিয়োগ আইনগুলো সংস্কার করা হোক। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ অন্যান্য দল এ কাউন্সিল গঠনের পক্ষে। ঐকমত্যে এনসিসি গঠন সম্ভব না হলে গণভোট চায় জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা না কমালে জুলাই সনদে সই না করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে এনসিপি।
গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের তৃতীয় দিনে ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোট সংস্কার আলোচনায় অংশ নেয়। এনসিসি ছাড়াও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দেয় দলগুলো।
গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের যৌথ বিবৃতির প্রতিবাদে আগের দিন সংলাপ বর্জন করা জামায়াত গতকাল আলোচনার টেবিলে ফেরে। তবে জামায়াতকে বেশি কথা বলার সুযোগ দেওয়ার প্রতিবাদে ওয়াকআউট করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি এবং গণফোরাম। ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা ১০ মিনিটের মাথায় তাদের ফিরিয়ে আনেন।
সংলাপে উত্তপ্ত বাদানুবাদ হলেও মধ্যহ্ন বিরতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পরস্পর হাত ধরে হাসিমুখে সংবাদমাধ্যমে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান; কুশল বিনিময় করেন।
সংলাপে সভাপতিত্ব করা ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, অধিকাংশ দল মনে করে, এনসিসি হওয়া উচিত। কিছু দলের আপত্তি রয়েছে। তারা চাইলে বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারেন। আজ (গতকাল) খানিক অগ্রগতি হয়েছে।
এনসিসির কোনো জবাবদিহি থাকবে না– বিএনপির এ অভিযোগের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, প্রধান বিচারপতি ছাড়া এনসিসির বাকি সদস্যরা নির্বাচিত। তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর কাছেই জবাবদিহি রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসে পক্ষে-বিপক্ষে মত
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মানবাধিকার কমিশন এবং প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান পদে এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল। পৃথক আইনে এতদিন নিয়োগ হলেও সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে আদতে প্রধানমন্ত্রীই এসব নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
সরকারপ্রধানের এই ক্ষমতা কমাতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান বিচারপতি, সংসদের উভয় কক্ষের স্পিকার, দুই বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার এবং সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের বাইরে থেকে একজন নির্বাচিত এমপি নিয়ে এনসিসি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। ৯ সদস্যের এই কাউন্সিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেবে বলে প্রস্তাব করেছে।
বিএনপি শুরু থেকেই এনসিসি গঠনের বিরোধী। গতকালের সংলাপ শেষে সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এনসিসি গঠনে নির্বাহী বিভাগের (সরকার) ক্ষমতা কমে যাবে। জবাবদিহি নেই, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি সমর্থন জানাতে পারে না। এনসিসিকে সাংবিধানিকভাবে অনেক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের জবাবদিহি নেই। যদি কারও কর্তৃত্ব থাকে, তবে জবাবদিহিও থাকতে হবে।
২০২২ সালের জুলাইয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনে করা আইনের সমালোচক ছিল বিএনপি। প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ করা নির্বাচন কমিশনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকলে অতীতের নির্বাচনগুলো এভাবে হতো না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি নির্বাচন কমিশনকে প্রকৃতভাবে, স্বাধীনভাবে, আইনিভাবে কার্যকর করতে দিই, তাহলে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ স্বৈরাচার হবে না।
এনসিসি নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করবেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিকল্প কোনো প্রস্তাব যদি আসে দলীয়ভাবে আলোচনা করব। তা নিয়ে আমাদের আবার চিন্তা করতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবমুক্ত করতে বিদ্যমান নিয়োগ আইনগুলোকে শক্তিশালী করতে চায় তার দল। যেসব আইন আছে, বিএনপি সেগুলোর সমালোচক। আইন শক্তিশালী করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ নিয়োগ সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ভারসাম্য তৈরি করা হবে। আগামী সংসদে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তা করা হবে।
সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, এলডিপি, ১২ দলীয় জোটও এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করেছে। যদিও সিপিবি বলছে, তারা সাংবিধানিক নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবমুক্ত করার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত। দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, এখন প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন।
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, এই মুহূর্তে এনসিসি গঠনের জন্য সময়ক্ষেপণ করা অপ্রয়োজনীয়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পক্ষে-বিপক্ষে
দলীয় অনুগত ব্যক্তি যাতে রাষ্ট্রপতি হতে না পারেন– সে জন্য কমিশন প্রস্তাব করেছে ৬৪ জেলা এবং ১২ সিটি করপোরেশনও হবে ‘ইলেকটোরাল কলেজ’। এ পদ্ধতিতে জেলার সব প্রতিনিধি রাষ্ট্রপতি ভোট দেবেন। প্রতিটি জেলার ভোটের সংখ্যা হবে।
পদ্ধতিতে নির্বাচনেও বিরোধিতা করেছে বিএনপি। একই অবস্থান এলডিপি, সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, ১২ দলীয় জোটের। সালাহউদ্দিন বলেছেন, বিএনপি বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। সংসদ দ্বিকক্ষের হলে উভয় কক্ষের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন। আওয়ামী লীগ আমলে গঠিত জেলা পরিষদে নির্বাচন দূষিত হয়েছে। কমিশন বলছে, স্থানীয় সরকারের ৭০ হাজার সদস্য, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মেয়র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটার হবেন। পাকিস্তান আমলে এ রকম বেসিক ডেমোক্রেসি ছিল। বিএনপি তাতে ফিরতে চায় না।