শিরোনাম
এইচএসসির খাতা কাটছেন শিক্ষার্থীরাই, ছবি ধারণ করে ছাড়ছেন ফেসবুক,টিকটকে নির্বাচনে এনসিপির কেউ জিততে পারবে না: ইশরাক নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মী এখন শিবির নেতা লালমনিরহাটে পুলিশ দেখে নদীতে ঝাঁপ, কিশোরের মিলছে না খোঁজ গাইবান্ধার তিস্তা নদী থেকে অজ্ঞাত বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার মেজর জিয়া চট্টগ্রাম থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন: নাহিদ কুড়িগ্রামে রাতের আঁধারে রড ছাড়াই সড়ক ঢালাইয়ের অভিযোগ, ক্ষোভের মুখে পালালেন ঠিকাদারের লোকজন সৈয়দপুর লায়ন্স স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থী হিসামের বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অর্জন। আ.লীগ হলো শাহী চাঁদাবাজ আর বিএনপি ছ্যাঁচড়া চাঁদাবাজ নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে অবাধে চলছে অবৈধ লটারির টিকেট বিক্রি
সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫, ০২:১৪ পূর্বাহ্ন

এইচএসসির খাতা কাটছেন শিক্ষার্থীরাই, ছবি ধারণ করে ছাড়ছেন ফেসবুক,টিকটকে

ডেস্ক রিপোর্ট / ৫ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫

চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভয়াবহ অনিয়মের চিত্র ধরা পড়েছে। খাতা যাচাইয়ের মতো গোপনীয় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা পরীক্ষকরা খাতার ওএমআর অংশ বা ‘বৃত্ত’ পূরণের কাজ শিক্ষার্থীদের দিয়ে করিয়েছেন। বিষয়টি সামনে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ও স্থিরচিত্রের মাধ্যমে। আবার এ নিয়ে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বেশ কয়েকজন পরীক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা।

বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র (বিষয় কোড-১০৮), উচ্চতর গণিত (বিষয় কোড-১২৬) এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্রের (বিষয় কোড-১০২) খাতা মূল্যায়নে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।

এ নিয়ে অভিযুক্ত পরীক্ষকরা হলেন— রাজধানীর ডেমরার রোকেয়া আহসান কলেজের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মুরছানা আক্তার, মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চতর গণিতের শিক্ষক মহসীন আলামীন, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের পরীক্ষক মো. সাখাওয়াত হোসাইন আকন, রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষক সমীরময় মন্ডল, নবাবগঞ্জের মুন্সীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার আনসার ভিডিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিষয়ের প্রভাষক মো. রাকিবুল হাসান।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা নিয়ে নিয়মবহির্ভূত যে ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মজা, বিদ্রুপ ও হাস্যরসের উপস্থাপন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। টিকটক, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটলেই দেখা যাচ্ছে– খাতা কাটছেন শিক্ষার্থীরাই, কেউ আবার খাতা হাতে বসে খিচুড়ি, লুচি, পরোটা খাচ্ছেন। যেখানে একপাশে রাখা খাতা, আরেক পাশে চাটনি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই খাতার ওএমআর অংশ (বৃত্ত) পূরণ করছেন। কোথাও কোথাও একাধিক শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বসে খাতা পূরণ করতে দেখা গেছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি শেয়ার করে এক শিক্ষার্থী ক্যাপশন দিয়েছেন– ‘বোর্ডের খাতা কাটছে টিকটকার’। আরেকজন লিখেছেন– ‘তোমাদের খাতা এখন আমাদের হাতে’। কেউ কেউ আবার ফল নিয়েও মজা করে লিখেছেন— ‘কে ভাই এইটা ৯২ পাইছে’। এসব পোস্ট এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

এ অবস্থায় উদ্বেগ, হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার খাতার গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর তারা প্রশ্ন তুলছেন কেন্দ্রীয় পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের যথাযথ পদ্ধতি ও বোর্ডের নজরদারি নিয়ে। যা নিয়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে বিশ্বাসযোগ্যতা ও সার্বিক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী তাহসিন ইসলাম বলেন, পরীক্ষার খাতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, মনে হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ এখন টিকটকারদের হাতে। বোর্ডের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। নইলে যারা পরিশ্রম করে তারা প্রতারিত হবে। আর এ ঘটনাগুলো দেখার পর মনে হচ্ছে– ফলাফল যাই আসুক, সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। গোপনীয়তা রক্ষা না হলে বোর্ড পরীক্ষার কোনো মূল্যই থাকে না। আমরা আতঙ্কে আছি।

রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার বলেন, যে পরিশ্রমটা করেছি, সেটা যদি সঠিকভাবে মূল্যায়নই না হয়, তাহলে তো সবই বৃথা। নিজের খাতার নম্বর কেউ এভাবে ভাইরাল করে দেবে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনায় আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এমনিতেই এসএসসির ফল বিপর্যয় দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। তার ওপর প্রতিনিয়ত এমন চিত্র ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি। যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টির সত্যতা নিরূপণ করে ব্যবস্থা নেওয়া।

এইচএসসি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে এমন অনিয়ম নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিভাবকরাও। এক পরীক্ষার্থীর মা মুসলিমা আক্তার বলেন, আমার ছেলেটা সারা বছর ভালো পড়েছে, মডেল টেস্টে ভালো করেছে। কিন্তু এখন শুনছি পরীক্ষার খাতার মূল্যায়নে অনিয়ম হচ্ছে, এটা খুব কষ্টের। ওদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এইচএসসির ফল। আর এবার এমনিতেই কড়াকড়িভাবে খাতা মূল্যায়নের কথা শুনেছি। সবমিলিয়ে অভিভাবক হিসেবে আমি খুব চিন্তায় আছি।

সাভার থেকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া নাহিদ হাসান বলেন, আমাদের উত্তরপত্র কারা দেখছেন সেই নিশ্চয়তা থাকছে না। বোর্ড পরীক্ষার মতো বড় একটা ব্যাপারে যদি এমন অনিয়ম হয়, তাহলে আর কিছুই বলার নেই। অনেকেই বলছে– এক খাতায় কেউ ৮০ দিচ্ছে, আবার কেউ ৪৫। তাহলে তো ফল নির্ভর করছে কে খাতা দেখছে তার ওপর। এটা ভয়াবহ। আমরা দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা দেখতে চাই। যেন কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন এভাবে ভুল কারো হাতে ভেঙে না পড়ে।

উদ্বেগ জানিয়ে মিজানুর রহমান নামের আরেক অভিভাবক বলেন, আমরা সন্তানদের কষ্ট করে পড়াশোনা করাই, যাতে তারা ভালো ফল করে এগোতে পারে। কিন্তু বোর্ড যদি খাতা ঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে, তাহলে সব পরিশ্রম বৃথা। সঠিক তদন্ত হোক, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। অভিভাবক হিসেবে আমাদের এটাই চাওয়া।

বিষয়টি নিয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বলেন, বর্তমানে পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন নিয়ে যেসব অনিয়মের খবর আসছে তা শুধু হতাশাজনকই নয়, এগুলো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা টালমাটাল করে দিচ্ছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি দেখেছি, অনেক সময় খাতা নেওয়ার তাড়াহুড়া, মূল্যায়নে সময়ের স্বল্পতা অথবা আর্থিক লাভের আশায় কিছু শিক্ষক নিজের খাতা অন্যকে দিয়ে মূল্যায়ন করিয়ে থাকেন। আবার অনেক সময় যারা খাতা মূল্যায়নের যোগ্য নন, তারাও বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে দায়িত্ব পেয়ে যান।

প্রকৃত মেধাবীদের ফলে এর প্রভাব পড়ে, আবার দুর্বল শিক্ষার্থীরা বাড়তি নম্বর পেয়ে যায়। এতে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা লাগে, অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, এ সমস্যার সমাধানে বোর্ডগুলোর মনিটরিং জোরদার করতে হবে। খাতা কোন শিক্ষক নিচ্ছেন, কে মূল্যায়ন করছেন, সেটা একটি ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেমে রাখতে হবে। মূল্যায়নের পর ৫-১০ শতাংশ খাতা রিভিউ করার একটি স্বতন্ত্র টিম থাকতে হবে। প্রয়োজনে একটি ‘র‍্যান্ডম অডিট’ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যেখানে বাছাই করা খাতা দ্বিতীয়বার মূল্যায়ন হবে। সেইসঙ্গে পরীক্ষকদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়নের আগে একটি কোড অব কনডাক্টে সই করানো যেতে পারে।

এই শিক্ষক বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মূল্যায়নের দায়ভার নিতে হবে পরীক্ষককেই। অন্যকে দিয়ে খাতা দেখানো যেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, সেটির নজির থাকতে হবে। শুধু দোষারোপ না করে এই প্রক্রিয়াটিকে পেশাদার ও আধুনিক করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

পাবলিক পরীক্ষার খাতার মূল্যায়ন নিরপেক্ষ, নিয়মভিত্তিক ও নৈতিকতা অনুসরণ করে হতে হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি বলেন, যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তবে সেটি গোটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ