ইরান ও ইসরায়েলের ১২ দিনের যুদ্ধের শেষ দিকে চালানো এক ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় উন্মোচিত হয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তাব্যবস্থার গুরুতর দুর্বলতা। ইরানের ‘খাইবার শেকান’ নামের বহু ওয়ারহেডযুক্ত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বির শেভায় একটি আবাসিক ভবনের পাশে বিস্ফোরণ ঘটায়। গত মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে চালানো ওই হামলায় একই পরিবারের চারজন নিহত হন, যারা ভবনের ‘নিরাপদ’ কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর ফলে ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮ জনে। তবে এই হামলা স্পষ্ট করেছে-উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের সাধারণ মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে।
ইরান দাবি করেছে, তারা ‘খাইবার শেকান’ নামের বহু ওয়ারহেডবিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, যেটিকে অনেকেই ‘দানব মিসাইল’ বলছেন। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজগ একে ইরানের সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্রগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, ইসরায়েলের মতো একটি আধুনিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এই হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এটিই ইসরায়েলের নিরাপত্তাব্যবস্থার বড় দুর্বলতা, যাকে এখন অনেকেই ‘অ্যাকিলিস হিল’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।
‘অ্যাকিলিস হিল’ একটি রূপক শব্দ, যার অর্থ হলো ‘দুর্বলতা’ বা ‘ভঙ্গুর স্থান’। এটি গ্রিক পুরাণের অ্যাকিলিসের পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে অ্যাকিলিসের একমাত্র দুর্বল স্থান ছিল তার গোড়ালি। এই স্থানটিতে আঘাত পেয়েই তার মৃত্যু হয়েছিল। তাই কোনো ব্যক্তি বা
বস্তুর সামগ্রিক শক্তি বা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যেখানে তার দুর্বলতা বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তাকে ‘অ্যাকিলিস হিল’ বলা হয়।
ইসরায়েলে ওই হামলার পর সবচেয়ে চোখে পড়েছে সাধারণ মানুষের দুরবস্থা। বির শেভা ও পেতাহ তিকভায় নিহতরা বেশির ভাগই সরকারি অনুমোদিত আশ্রয়কক্ষে ছিলেন। অথচ সেসব কক্ষও তাদের রক্ষা করতে পারেনি।
তেল আবিব শহরের ডিজেঙ্গফ সেন্টারের নিচে এখন একটি অস্থায়ী তাঁবু নগরী গড়ে উঠেছে। যেখানে আগে বিলাসবহুল গাড়ি রাখা হতো, সেখানে এখন শত শত মানুষ ছোট ছোট তাঁবুতে রাত কাটাচ্ছেন। যাদের নিজস্ব নিরাপদ ঘর নেই বা যাদের ঘর অরক্ষিত, তারাই আশ্রয় নিয়েছেন এখানে।
৬১ বছর বয়সী সাবেক সাবমেরিন ক্যাপ্টেন রোনেন কোহলার বলেন, ‘বাইরের দুনিয়া ভাবে তেল আবিবে আধুনিক আশ্রয় কক্ষ আছে। বাস্তবে অনেক ভবন ৪০ বা ৫০ বছর আগে তৈরি, সেগুলো সে অর্থে নিরাপদ নয়।’
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলে নতুন ভবনে ‘মামাদ’ নামে ব্যক্তিগত নিরাপদ ঘর রাখার নিয়ম চালু হয়। এ ছাড়া রয়েছে প্রতিটি ফ্লোরে ‘মামাক’ এবং সরকারি ‘মিকলাট’। কিন্তু বাস্তবে এসব আশ্রয় সুবিধা পান মূলত ধনীরা।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলের ৫৬ শতাংশ বাড়িতে কোনো নিরাপদ কক্ষ নেই এবং ১২ হাজার পাবলিক আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থা জরাজীর্ণ বা ব্যবহারের অনুপযোগী।
হাইফার বাসিন্দা রিনাত ওয়েইনবার্গ জানান, তার ফ্ল্যাটের তথাকথিত নিরাপদ কক্ষে শক্ত দরজা নেই। বালু আর পাথরের বস্তা দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঘরে থেকে নিরাপদ বোধ করি না, তাই ডিজেঙ্গফের নিচে এসে আশ্রয় নিয়েছি।’
এ ছাড়া দক্ষিণ তেল আবিবের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের নিচেও একটি তাঁবুর শহর গড়ে উঠেছে। সেখানে অবস্থান করছেন লিন টাগাকাই নামের এক ফিলিপিনো কর্মী। তিনি বলেন, ‘আমার ১১ মাসের ছেলে কাইলকে নিয়ে ওপরের কোনো আশ্রয়ে পৌঁছানো সম্ভব হতো না। তাই নিচে থাকা নিরাপদ মনে হয়েছে।’
সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক এখন এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, যাদের নিজস্ব আশ্রয় কক্ষ আছে, তারাও নিচে নেমে পার্কিং লট বা সাবওয়েতে রাত কাটিয়েছেন। শুধু শিশু নয়, অনেক বয়স্ক নাগরিকও এখন সাবওয়ে বা বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের উন্নত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ইরান যে বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে সক্ষম, তা এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের যুদ্ধ আবারও হতে পারে এবং সাধারণ নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও আতঙ্ক কাটছে না। কারণ, ইরানের কাছে এখনো শত শত ব্যালিস্টিক মিসাইল রয়েছে। আর ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শতভাগ কার্যকর নয়।
তাই এখন প্রশ্ন একটাই- ইসরায়েল সরকার কীভাবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? কেন এত বছর পরও লাখো মানুষ আশ্রয়হীন অবস্থায় আছেন? আর পরবর্তী যুদ্ধ শুরু হলে সেই উত্তরের খোঁজে হয়তো আর সময়ও পাওয়া যাবে না।