জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ৪ আগস্ট রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক হয়। সেখানে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়ার পরামর্শ দেন কেউ কেউ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো, গণভবনে কবর দিয়ে দাও।’
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) রোববার দাখিল করা হয়েছে। প্রসিকিউশনের পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই চার্জ দাখিল করা হয়।
দাখিল করা এক নথিতে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণ-অভ্যুত্থান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের প্রেক্ষাপট ঘিরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে।
নথিতে বলা হয়, ৪ আগস্ট রাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘গ্যাং অব ফোর’ নামে পরিচিত চারজন শীর্ষ নেতা-দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পরামর্শে কঠোর অবস্থানে যান। তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে নিরুৎসাহিত করেন এবং সেনা-পুলিশ সমন্বয়ে আন্দোলন দমনের পরিকল্পনা নেন।
নথিতে উল্লেখ করা হয়, জুলাই আন্দোলনের সময় ৪ আগস্ট রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের গোপন বৈঠক হয়। সেখানে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের দমন করতে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে চান। তবে উপস্থিত সামরিক কর্মকর্তারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়ার পরামর্শ দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো, গণভবনে কবর দিয়ে দাও।’
৪ আগস্ট দুপুর থেকে ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত গণভবনে চলা নানা বৈঠকে শেখ হাসিনা আন্দোলন দমন করতে
তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, এই লোকটি আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডুবাবে। ঠিক এ সময় একজন অপরিচিত ব্যক্তি গণভবনে প্রবেশ করলে শেখ হাসিনা সভা শেষ করেনসর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে বলেন। নথিতে বলা হয়, সেনাবাহিনী প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, যা হওয়ার হবে, আমি ক্ষমতা ছাড়ব না।
ট্রাইব্যুনাল নথি অনুসারে, শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা পর্যন্ত পা ধরে অনুরোধ করেছিলেন পদত্যাগ করার জন্য, তবে তাতেও রাজি হননি তিনি। পরে সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জয় মাকে পরিস্থিতি বোঝাতে সক্ষম হন এবং এরপরই শেখ হাসিনা পদত্যাগে সম্মত হন।
নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন একটি বিদায়ি ভাষণ টেলিভিশনে প্রচার করতে, তবে সামরিক কর্মকর্তারা তা অনুমতি দেননি। ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র দেন এবং পরে ভারতে পালিয়ে যান। গণভবনে রুদ্ধদ্বার অবস্থায় কাটানো শেষ দুই দিনে তিনি যে কোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলেন।
নথিতে বলা হয়, শেখ হাসিনার নির্দেশে অপরাপর আসামিরা ঢাকা মহানগরীর চানখাঁরপুল এলাকায় নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। গুলিতে স্কুলছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিয়ার শহীদ হন।
এ মামলার পলাতক আসামি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। তিনি একটি উচ্চপদে থেকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহ হয়ে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার ওপর গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে সুদীপ কুমার চক্রবর্তী ৫ আগস্ট সকাল ৬টায় শাহবাগ থানায় উপস্থিত হন। এ সময় আন্দোলনকারীরা যেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যেতে না পারে, সেজন্য পুলিশ কমিশনারের নির্দেশ মোতাবেক অধীনস্থ পুলিশ সদস্যরা সরাসরি গুলি করেন।
নথিতে আরও বলা হয়, ১৪ জুলাই রাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ও নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। হামলার সুযোগ করে দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের ভাষ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত গণহত্যা চালিয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেন। তার বিরুদ্ধে এমন তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে, যা বিশ্বের যে কোনো আদালতে দাখিল করা হলে তাকে অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।