জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রাম এখন ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে পরিচিত। দারিদ্র্য, প্রতারণা ও দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে এ গ্রামের অসংখ্য মানুষ ভারতে গিয়ে নিজেদের কিডনি বিক্রি করেছেন। অজানা এক যন্ত্রণার নাম হয়ে উঠেছে এই গ্রাম, যেখানে একেকটি বাড়ির দেয়ালে লুকিয়ে আছে একটি করে অপারেশনের দাগ।
বাইগুনির ৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন ২০২৪ সালে নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেন ভারতের এক ব্যক্তির কাছে। বিনিময়ে পান সাড়ে তিন লাখ টাকা। উদ্দেশ্য ছিল সন্তানদের জন্য একটি ঘর তৈরি করা, পরিবারকে টেনে তোলা দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে। কিন্তু সেই টাকা কবে শেষ হয়ে গেছে তা তিনি নিজেও বলতে পারেন না। ঘরের কাজ বন্ধ, আর অপারেশনের পর শরীরের যে অসহনীয় ব্যথা, তা প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়—একটি ভুল সিদ্ধান্ত কীভাবে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।
ভারতে যাওয়ার সময় সফিরুদ্দিনের ভিসা, ফ্লাইট ও হাসপাতালের সব কাগজপত্র ঠিক করে দেয় দালাল চক্র। মেডিকেল ভিসায় যাওয়ার সময় নিজের পাসপোর্ট ব্যবহার করলেও, হাসপাতালের কাগজে তাকে রোগীর আত্মীয় দেখানো হয়। তৈরি করা হয় ভুয়া জন্মসনদ, নকল আইডি ও নোটারি সার্টিফিকেট। অপারেশনের পর নিজের কাগজপত্র কিছুই ফেরত পাননি সফিরুদ্দিন। এমনকি ওষুধটুকুও দেওয়া হয়নি তাকে। শারীরিক দুর্বলতা নিয়েই এখন কাজ করেন একটি হিমাগারে, প্রতিদিনের জীবন চলছে সীমাহীন কষ্টে।
ভারতের আইনে কিডনি প্রতিস্থাপন শুধু নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই বৈধ। তবে সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে অন্য কেউ দান করতে পারে। কিন্তু দালাল চক্র আইনকে ফাঁকি দিতে তৈরি করে ভুয়া সম্পর্ক ও নথিপত্র।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন টাস্কফোর্সের সদস্য ড. মনির মোনিরুজ্জামান বলেন, এসব প্রতারণার ধরন প্রায় এক—নাম পরিবর্তন, জাল আইডি, ভুয়া আত্মীয়তা এবং নোটারি সার্টিফিকেট বানানো।
বাইগুনির চিত্রটা বিচ্ছিন্ন নয়। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কালাই উপজেলায় প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। তাদের বেশিরভাগই ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষ, যারা দারিদ্র্য, ঋণ, মাদক বা জুয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে গিয়ে এই পথে বাধ্য হয়েছেন। অথচ অপারেশনের পর তাদের অনেকেই নিয়মিত চিকিৎসা তো দূরের কথা, প্রয়োজনীয় ওষুধটুকুও পান না।
কেউ কেউ প্রতারিত হয়ে কিডনি বিক্রির পর এই চক্রের অংশও হয়ে উঠেছেন। যেমন মোহাম্মদ সাজল (ছদ্মনাম), যিনি ২০২২ সালে দিল্লির এক হাসপাতালে ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে কিডনি বিক্রি করেন, কিন্তু হাতে পান মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা। পরে তিনিও বাংলাদেশ থেকে কিডনি বিক্রেতা সংগ্রহ করে ভারতে পাঠাতে থাকেন। তবে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ঝামেলায় পড়ে চক্র ত্যাগ করেন। এখন ঢাকায় রাইড শেয়ারিংয়ের গাড়ি চালান, কিন্তু পুরোনো জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা আজও তাকে তাড়া করে ফেরে।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তারা বলছেন, এই চক্রে দালালদের পাশাপাশি জড়িত থাকে হাসপাতাল, কাগজ তৈরি করা কর্মকর্তা এবং এমনকি কিছু চিকিৎসকও। প্রতিটি কিডনি ট্রান্সপ্লান্টে খরচ হয় ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা, যার বড় অংশই যায় এই চক্রের পকেটে। অথচ কিডনি বিক্রেতারা পান মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা।
ভারতের কিডনি ওয়ারিয়ার্স ফাউন্ডেশনের প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ বলেন, আইনি কাঠামো থাকলেও এই বাজারটি এখন এক ধরনের কালোবাজারে পরিণত হয়েছে। চাহিদা যেহেতু বন্ধ হচ্ছে না, তাই এই অসংগঠিত ও নিষ্ঠুর বাণিজ্যও থেমে থাকছে না।
২০১৯ সালে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছু তদন্ত চালায়। ২০২৪ সালে দিল্লিতে এক চিকিৎসক গ্রেপ্তারও হন, যিনি একাই ১৫ জন বাংলাদেশির কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন এই পদক্ষেপগুলো বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনসুলার বিভাগের মহাপরিচালক শাহ মুহাম্মদ তানভির মনসুর বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এই বিষয়ে কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নেই। ভারতীয় হাসপাতালগুলো প্রায়ই দায় এড়িয়ে যায়, বলে—তারা নথিপত্র যাচাই করেই অনুমোদন দিয়েছে।
বাইগুনি গ্রামে এখনো অনেকেই স্বপ্ন দেখেন বাড়ি বানানোর, সংসার গড়ার। কিন্তু সফিরুদ্দিনদের বাস্তবতা হলো—একটি কিডনি হারিয়ে তারা হারিয়েছেন স্বপ্ন, স্বাস্থ্য এবং সম্মান। আর তাদের হতাশ কণ্ঠে শুধু একটি বাক্যই ঘুরেফিরে আসে—‘তারা কিডনি নিলো, আর আমাকে ফেলে চলে গেল।’ [সূত্র: আল জাজিরা]